বৃহস্পতিবার ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
সম্পূর্ণ খবর
দেবস্মিতা | ০৫ অক্টোবর ২০২৪ ১৫ : ২৭Debosmita Mondal
গৌতম রায়
শ্রীলংকায় সংসদীয় ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বামপন্থীদের ক্ষমতা দখল, দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান ধর্মান্ধ মৌলবাদের দাপটকে রুখতে একটা বার্তা দেবে, সাহস জোগাবে। অনুরা কুমারা দিসানায়েক- এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার খবরে একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য নাম। মাত্র পাঁচ বছর আগে যে মানুষটি তাঁর দেশ শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রথম প্রার্থী হয়ে ভোট পেয়েছিলেন কেবলমাত্র ৩ শতাংশ, সবার সব হিসেবকে উলটপালট করে দিয়ে, সেই মানুষটিই ২০২৪ সালে ৪২ শতাংশ ভোট পেয়ে, বামপন্থী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শ্রীলঙ্কায় দায়িত্বভার গ্রহণ করতে চলেছেন।
দীর্ঘকাল ধরে শ্রীলংকার রাজনীতিতে অভিজাত পরিবার থেকে উঠে আসা, বিত্তবান মানুষদের একটা আধিপত্য ছিল। সেই আধিপত্য শ্রীলংকার আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশের উপরে কী প্রভাব ফেলেছিল, তাদের সাম্প্রতিক অতীত থেকে তা এখন গোটা দুনিয়ার কাছে খুব পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।
সেই জায়গায় শ্রীলংকার এক শ্রমিক পরিবারের সন্তান দিসানায়েক, যিনি ছাত্রজীবন থেকেই সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, ঘোষিতভাবে একজন মার্কসবাদী লেলিনবাদী দলের সাধারণ কর্মী থেকে ২০১৪ সালে, সেই দলের প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করে, নিজের দলের অতীতের নানা ধরনের রাজনৈতিক উত্থান পতন, নানা ভুলভ্রান্তিকে অতিক্রম করে, সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁর প্রতি, তাঁর দলের প্রতি সমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন সেটি দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার নিরিখে নিঃসন্দেহে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা।
দিসানায়েক যে শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিতে সে দেশের রাষ্ট্রপতি হবেন, এটা আন্তর্জাতিক দুনিয়া বিন্দুমাত্র অনুমানই করতে পারেনি। বিশেষ করে মাত্র পাঁচ বছর আগে যে মানুষটি বা যে দলটির প্রতি সে দেশের মানুষ কেবলমাত্র ৩ শতাংশ আস্থাজ্ঞাপন করলেন, সেই দলটির প্রতি ঠিক পাঁচ বছর পর সেই মানুষই ৪২ শতাংশ আস্থাজ্ঞাপন করে দলটিকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করলেন- এটা নিঃসন্দেহে একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা।
জনতা বিমুক্তি পেরামুনা নামে যে দলটি নেতৃত্বে বাম জোটের ন্যাশনাল পিপল পাওয়ারের প্রার্থী হিসেবে দিসানায়ক শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন, সেটি কিন্তু বিগত কয়েক বছরে, ওই দেশে নানা ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, সামাজিক অস্থিতিস্থাপকতা- এসবের নিরিখে বিশেষ রকমের উল্লেখের দাবি রাখে। দিসানায়েক যে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, মানুষের সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রপতি পদে অভিষিক্ত হলেন, সেই দলটি কিন্তু জন্মলগ্ন থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল না। সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তাঁর দল জন্মলগ্নে দেখত।
সেই দেখার ভেতর থেকে সাতের দশকের শুরুর দিকে একবার আর আটের দশকের শেষ দিকে দু-দুবার তাঁরা ব্যর্থ সশস্ত্র বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটাবার চেষ্টা করেছিল। সার্বিকভাবে সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ব্যর্থ হয়। তাঁদের দলের হাজার হাজার বিপ্লবী কর্মীর মৃত্যু ঘটে। এই যে সময়কালটা সেটা শ্রীলংকার রাজনৈতিক ইতিহাসে একটা অন্যরকম রাজনৈতিক কার্যক্রম হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জে ভি পি) দলটি নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে, নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানে পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করে। সশস্ত্র বিপ্লবের পথে সমাজ বদলের যে রাজনৈতিক অবস্থান তাঁদের ছিল সে জায়গা থেকে তাঁরা নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে সরকারিভাবে সরে আসতে শুরু করে।
সংসদীয় রাজনীতিতে আস্থাবান হয়ে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করে দলটি। দিসানায়েক এই সময়কালেই ছাত্র-যুব আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে, সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে ছাত্র যুবদের মধ্যে একটা বড় রকমের রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরি করেন। এভাবে নিজের এবং তাঁর দলের একটা জনপ্রিয়তা তৈরি করেন। ২০০০ সালে তিনি প্রথম শ্রীলঙ্কার সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারপর জোট সরকারে অংশ নিয়ে মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছিলেন। জেভিপি দলের দায়িত্ব তাঁর উপরে অর্পিত হয় ২০১৪ সালে। এই সময়কাল থেকেই শ্রীলংকার রাজনীতিতে ধনী অভিজাত মানুষদের যে আধিপত্য, তার জায়গায় অতি সাধারণ শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি জনতা, ছাত্র -যুব --তাঁদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দিসানায়েক নিজের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে, মতাদর্শকে পরিচালিত করতে শুরু করেন।
গরিব গুর্বো, খেটে খাওয়া মানুষদের মধ্যে অভিজাত শ্রেণীর রাজনীতি প্রতি যে বিরক্তি, তার একটা ফসল ঘরে উঠতে থাকে জেভিপি দলের ঘরে। বিগত ২০১৯ সালের নির্বাচনে দিসানায়েকের শোচনীয় পরাজয় ঘটলেও, ধনী অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণাধীন রাজনীতি গত পাঁচ বছরে শ্রীলংকার বুক থেকে যেভাবে ধীরে ধীরে অতীত ইতিহাস হয়ে দাঁড়াতে শুরু করেছিল, সেটি কিন্তু এই মার্কসবাদী লেনিনবাদী দল জেভিপির পক্ষে, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সমর্থনের দিকটাকে জোরদার করতে শুরু করে।
গোটা দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে সাম্প্রতিক অতীতে যেভাবে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি জোরদার হয়ে উঠছে এবং এই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষজন দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে করায়ত্ত করছে, তার প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা ধরেই নিয়েছিলেন, বামপন্থীরা সেভাবে কিছু দাগ কাটার মত অবস্থান আদৌ নিতে পারবেন না শ্রীলংকাতে। একটা বড় অংশের তাত্ত্বিকদের ধারণা ছিল, অভিজাত রাজনীতির প্রতি শ্রীলংকার সাধারণ মানুষ কিছুদিন আগে যতই বিরক্তি দেখাক না কেন, অভিজাত রাজনীতির প্রতি আনুগত্যের চেনা পথেই তাঁরা হাঁটবেন। শ্রীলংকার মানুষ সম্বন্ধে এই নির্বাচনের আগে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় যেসব লেখা প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে বেশিরভাগ মানুষই মন্তব্য করেছিলেন, প্রচলিত ধারার বাইরে পা রেখে, নতুন ধরনের কোনও বিপদ ডেকে আনতে সে দেশের মানুষ সম্ভবত চাইবেন না।
আসলে দিসানায়কের যে রাজনৈতিক অবস্থান, সেটি ভয়ঙ্কর রকমভাবে প্রতিষ্ঠান বিরোধী। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর যে অবস্থান, সেটি সে দেশের অভিজাত সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা, প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিকদের কাছে ভীষণরকম অপছন্দের একটি বিষয়। সে দেশের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের আগে প্রচার পর্বে প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিকরা দিসানায়কের এই প্রতিষ্ঠান বিরোধী অবস্থান, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান, রাজনৈতিক সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা -এই সমস্ত দিকগুলিকে তাদের মত করে উপস্থাপিত করে, সাধারণ মানুষের মধ্যে দিসানায়ককে ঘিরে বা তাঁর দলকে ঘিরে এক ধরনের আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে দিতে চেয়েছিল।
প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিকরা তাদের প্রচলিত সুবিধাবাদী ধারাকে, শ্রীলংকার আর্থ- সামাজিক উন্নয়নের পক্ষে সবথেকে উপযোগী হিসেবে প্রচার করে। এমন ধরনের প্রচারও ভোটের আগে তারা চালিয়েছে, যাতে সাধারণ মানুষের ধারণা হয়, দিসানায়েক ক্ষমতায় এলে শ্রীলংকার সার্বভৌমত্বই বিপন্ন হবে। প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিকরা যেভাবে বামপন্থীদের সম্পর্কে প্রচার করে থাকে, ঠিক সেই ধারার আক্রমণের শিকার হয়ে সদ্য সমাপ্ত ভোটে দিসানায়ককে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। নির্বাচনী প্রচারপর্বে প্রতিষ্ঠিত ধারার এই অরাজনৈতিক ব্যক্তি আক্রমণাত্মক, কুরুচিকর প্রভাবের প্রচারের মোকাবিলার ক্ষেত্রে দিসানায়েক কিন্তু একবারের জন্যেও রাজনীতির বাইরে কোনওরকম অরাজনৈতিক, কুরুচিকর প্রচার করেননি। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির সাম্প্রতিক প্রচলিত ধারায় নির্বাচনী প্রচার ব্যবস্থাতে দিসানায়কের এই যে অবস্থান সেটাও কিন্তু ছিল অত্যন্ত ব্যতিক্রমী।
দিসানায়েক কিন্তু ভোটের প্রচারে শ্রীলংকার ভেঙে পড়া অর্থনীতির পুনর্গঠনের বার্তা, বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতির পুনর্গঠনের বার্তাকেই সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কায় এতকাল যাঁরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকেছেন, তাঁরা কখনও কোনও অবস্থাতে গ্রামীণ শ্রীলঙ্কাকে এতটুকু অগ্রাধিকার দেননি। তার পাশাপাশি বলতে হয়, শ্রীলঙ্কায় শ্রমিক স্বার্থ সুরক্ষিত রাখবার ব্যাপারেও অতীতের কোনও রাজনৈতিক দল বা শাসক এতটুকু গুরুত্ব আরোপ করেননি।
এই জায়গাতে গত নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর থেকেই তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে গ্রামীন শ্রীলংকার উন্নয়ন এবং সে দেশের শ্রমিকদের দুরবস্থাকে অত্যন্ত জোরদারভাবে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরেছিলেন দিসানায়েক। নির্বাচনী প্রচার পর্বেও তাঁর প্রধান অস্ত্র ছিল গ্রামীণ শ্রীলংকার পুনর্গঠন এবং শ্রমিকদের দুরবস্থার অবসান। ভোটের ফল থেকে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ মানুষ বামপন্থী দিসানায়কের এই রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রতি নিজেদের আস্থা জ্ঞাপন করেছেন।
শ্রীলংকার এই পালাবদল বামপন্থীদের হাতে দেশ পরিচালনার ভার নিঃসন্দেহে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে যে ক্রমবর্ধমান ধর্মান্ধ মৌলবাদের প্রসার, সাম্প্রদায়িকতার প্রসার, সাম্রাজ্যবাদের প্রতি প্রবল আনুগত্য, চরম প্রতিক্রিয়াশীল সামাজিক আবর্তনের দিকে আকর্ষণ- এই সমস্ত প্রবণতার বিরুদ্ধে একটা সোচ্চার কন্ঠ হিসেবে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করবে। আশা করা যায় তার প্রভাব ধীরে ধীরে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলির মধ্যেও সূচিত হতে শুরু করবে।